![]() |
হেলেন কেলার, ছবি ক্রেডিট: alabs.ie |
দিব্য চাকমা, ২য় বর্ষের শিক্ষার্থী, সরকারি বিজ্ঞান কলেজ, ঢাকা
পৃথিবীর ইতিহাসে এমন কিছু মানুষ আছেন, যাঁদের জীবন তাঁদের শারীরিক সীমাবদ্ধতাকে ছাপিয়ে এক অসাধারণ কীর্তিতে রূপান্তরিত হয়েছে। হেলেন কেলার ছিলেন তাঁদের মধ্যে অন্যতম। ১৮৮০ সালে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের অ্যালাবামায় জন্ম নেওয়া এই নারী মাত্র ১৯ মাস বয়সে এক রহস্যময় রোগের কারণে দৃষ্টিশক্তি এবং শ্রবণশক্তি উভয়ই হারান। তাঁর জীবন থেকে আমরা কেবল প্রতিবন্ধকতাকে জয় করার গল্পই শিখি না, বরং মানব মনের অদম্য ইচ্ছাশক্তি, ধৈর্য এবং জ্ঞানার্জনের প্রতি গভীর ভালোবাসা সম্পর্কেও জানতে পারি।
শৈশব এবং
অন্ধকারময় দিনগুলি
ছোটবেলায় হেলেন ছিলেন জেদি ও
আক্রমণাত্মক। যেহেতু তিনি দেখতে বা শুনতে
পেতেন না, তাই বাইরের পৃথিবীর সাথে তাঁর যোগাযোগের কোনো মাধ্যম ছিল না। তাঁর নীরব আর অন্ধকারময় জগৎ তাঁকে এতটাই হতাশ
করে তুলেছিল যে, প্রায়ই তিনি জিনিসপত্র ছুড়ে ফেলতেন এবং নিজের রাগ প্রকাশ করতেন। তাঁর বাবা-মা তাঁর এই অসহায় অবস্থা দেখে দিশাহীন
হয়ে পড়েন। চিকিৎসকরাও যখন হাল ছেড়ে
দিলেন, তখন তাঁর মা চার্লস ডিকেন্সের লেখা একটি প্রবন্ধ থেকে অনুপ্রাণিত হয়ে
বোস্টনে দৃষ্টি প্রতিবন্ধীদের একটি স্কুল, পারকিন্স ইনস্টিটিউটের সাথে যোগাযোগ
করেন। সেই স্কুল থেকে তাঁরা একজন বিশেষ শিক্ষিকা
পেলেন— যাঁর নাম অ্যানি সুলিভান।
![]() |
অ্যানি সুলিভানের সঙ্গে হেলেন কেলার, ছবি ক্রেডিট: wikimedia |
অ্যানি
সুলিভানের আগমন: এক নতুন দিগন্ত
১৮৮৭ সালের ৩ মার্চ হেলেন কেলারের
জীবনে এক নতুন অধ্যায়ের সূচনা হয়। ২৬ বছর
বয়সী অ্যানি সুলিভান, যিনি নিজেও প্রায় অন্ধ ছিলেন, হেলেনের জীবনে প্রবেশ করেন। তিনি হেলেনের জেদ ও হতাশাকে ধৈর্যের সাথে
মোকাবিলা করেন। প্রথমদিকে হেলেন কিছুতেই
শিখতে চাইতেন না, কিন্তু অ্যানি হাল ছাড়েননি । তিনি একটি পুতুল দিয়ে হেলেনকে
বোঝানোর চেষ্টা করেন যে, প্রতিটি বস্তুর একটি নাম আছে। অ্যানি হেলেনের হাতে d-o-l-l বানানটি আঙুল দিয়ে
লিখে বোঝান। প্রথম দিকে হেলেন এর অর্থ বুঝতে পারছিলেন না।
এর কয়েক সপ্তাহ পর, একটি অলৌকিক ঘটনা
ঘটে। অ্যানি হেলেনকে একটি পানির পাম্পের
কাছে নিয়ে যান এবং তাঁর হাতের ওপর ঠাণ্ডা জল ঢালেন। একই সময়ে তিনি হেলেনের অন্য হাতে w-a-t-e-r
শব্দটি আঙুল দিয়ে লিখে বুঝিয়ে দেন। হঠাৎ
করেই হেলেনের কাছে সব পরিষ্কার হয়ে যায়। তিনি
বুঝতে পারেন যে, তাঁর হাতের ওপর যে ঠাণ্ডা, তরল পদার্থটি পড়ছে, সেটির একটি নাম
আছে— পানি। এই আবিষ্কারটি ছিল
হেলেনের জীবনের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ মুহূর্ত। এরপর থেকে তিনি সবকিছু সম্পর্কে জানতে আগ্রহী
হয়ে ওঠেন। তাঁর মনে প্রশ্ন জাগে, কেন
প্রতিটি জিনিসের একটি নাম আছে এবং সেই নামগুলো কী। এরপর হেলেন দ্রুত শব্দ এবং বাক্য গঠন শিখতে শুরু
করেন।
শিক্ষা এবং
উচ্চশিক্ষা: এক অনন্য দৃষ্টান্ত
অ্যানি সুলিভানের সহায়তায় হেলেন কেলার
দ্রুত ব্রেইল পদ্ধতিতে পড়াশোনা শুরু করেন। তিনি তাঁর অসাধারণ স্মৃতিশক্তি এবং শেখার প্রতি
তীব্র আগ্রহ দিয়ে সবাইকে অবাক করে দেন। তিনি
মাত্র কয়েক বছরের মধ্যে সাধারণ শিক্ষার্থীদের চেয়েও দ্রুত পড়াশোনায় এগিয়ে যান। এর পর তিনি কেমব্রিজ স্কুল ফর ইয়াং লেডিস-এ
ভর্তি হন এবং সেখানে উচ্চশিক্ষার জন্য প্রস্তুতি নেন। এই সময় তিনি লাতিন, গ্রিক, ফরাসি, জার্মান এবং
ইংরেজি সাহিত্য নিয়ে গভীর জ্ঞান অর্জন করেন।
১৯০০ সালে হেলেন কেলার ভর্তি হন র্যাডক্লিফ
কলেজ-এ, যা ছিল তৎকালীন সময়ে এক বিশাল ব্যাপার। কারণ, একজন দৃষ্টি ও শ্রবণশক্তিহীন মানুষের জন্য
একটি সাধারণ কলেজে পড়াশোনা করা ছিল প্রায় অসম্ভব। এই চার বছর অ্যানি সুলিভান তাঁর প্রতিটি ক্লাসে
হেলেনের পাশে বসে শিক্ষকের কথাগুলো তাঁর হাতে লিখে বোঝাতেন। অবশেষে, ১৯০৪ সালে হেলেন কেলার সম্মানসূচক
ডিগ্রি নিয়ে স্নাতক পাশ করেন। তাঁর এই
অর্জনটি ছিল সারা বিশ্বের প্রতিবন্ধী মানুষের কাছে এক বিরাট অনুপ্রেরণা। এটি প্রমাণ করে যে, উপযুক্ত সুযোগ ও সহায়তার
মাধ্যমে যেকোনো প্রতিবন্ধকতা অতিক্রম করা সম্ভব।
সমাজসেবা
এবং রাজনৈতিক সক্রিয়তা
হেলেন কেলার কেবল নিজের ব্যক্তিগত
সাফল্যেই সীমাবদ্ধ থাকেননি। তিনি ছিলেন
একজন দৃঢ়চেতা রাজনৈতিক কর্মী। তিনি
নারীদের ভোটাধিকার, শ্রম অধিকার এবং বিশ্বশান্তির পক্ষে কথা বলেছেন। তিনি পুঁজিবাদের সমালোচনা করে সমাজতান্ত্রিক
আন্দোলনের সাথেও যুক্ত ছিলেন। প্রথম
বিশ্বযুদ্ধের সময় তিনি যুদ্ধাহত সৈনিকদের পাশে দাঁড়িয়ে তাঁদের মনোবল বাড়াতে সহায়তা
করেন। তিনি বিভিন্ন দেশে ঘুরে ঘুরে প্রতিবন্ধী মানুষের অধিকারের জন্য জনসচেতনতা
তৈরি করেন এবং তাঁদের জন্য শিক্ষার সুযোগ তৈরির আহ্বান জানান। তাঁর অক্লান্ত পরিশ্রমের ফলস্বরূপ ১৯২০ সালে
তিনি আমেরিকান সিভিল লিবার্টিজ ইউনিয়ন (ACLU)
প্রতিষ্ঠায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন।
লেখক এবং
বক্তা হিসেবে হেলেন কেলার
হেলেন কেলার একজন অসাধারণ লেখক ও
বক্তা ছিলেন। তিনি তাঁর সারা জীবনে ১৪টি
বই এবং অসংখ্য প্রবন্ধ লিখেছেন। তাঁর
আত্মজীবনী "দ্য স্টোরি অফ মাই লাইফ" (The Story of My Life) সারা
বিশ্বে সবচেয়ে বেশি বিক্রি হওয়া বইগুলোর মধ্যে একটি। এই বইটিতে তিনি তাঁর শৈশব, অ্যানি সুলিভানের
সাথে তাঁর সম্পর্ক এবং কীভাবে তিনি প্রতিবন্ধকতাকে জয় করেছেন, তার বর্ণনা দিয়েছেন।
বইটি লক্ষ লক্ষ পাঠকের জীবনে নতুন করে
বাঁচার প্রেরণা জুগিয়েছে। তাঁর আরেকটি
বিখ্যাত বই হলো "আউট অফ দ্য ডার্ক" (Out of the Dark)। তিনি তাঁর বক্তৃতাগুলোতেও অত্যন্ত সাবলীল ছিলেন
এবং বিভিন্ন রাজনৈতিক ও সামাজিক বিষয়ে গভীর অন্তর্দৃষ্টি তুলে ধরতেন।
উপসংহার
১৯৬৮ সালে ৮৭ বছর বয়সে হেলেন কেলার
মারা যান। তিনি তাঁর জীবদ্দশায় পৃথিবীর
৫০টি দেশের মানুষকে অনুপ্রাণিত করেছেন। তাঁর
জীবন থেকে আমরা শিখি যে, জীবনের সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জগুলো অতিক্রম করা সম্ভব প্রবল
ইচ্ছাশক্তি, ধৈর্য এবং কঠোর পরিশ্রমের মাধ্যমে। তাঁর গল্প আমাদের মনে করিয়ে দেয় যে, মানুষের
প্রকৃত শক্তি তার বাহ্যিক গঠনে নয়, বরং তার অদম্য মনোবল এবং মানসিক দৃঢ়তায়। হেলেন কেলার দেখিয়ে গেছেন যে, জীবনের অন্ধকার আর
নীরবতার মধ্যেও কীভাবে আলোর দিশা খুঁজে নিতে হয় এবং নিজের জীবনের মাধ্যমে অন্যকে
আলোকিত করতে হয়। তাঁর জীবন চিরকাল
মানবতাকে পথ দেখাবে। (সমাপ্ত)
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন